ভিয়েতনামের প্রাচীন হিন্দু চাম বর্মন রাজাদের ইতিহাস।

খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতকে ভিয়েতনামের পূর্ব উপকূলে যে হিন্দু রাজ্য প্রতিষ্ঠা হয়েছিল এবং পরবর্তীকালে সমৃদ্ধশালী হয়েছিল তার রাজধানী হল চম্পা (Champa)। চম্পা সম্ভবত এই রাজ্যটির একটি অঙ্গদ্বীপ ছিল যা বায়ুপুরাণেও উল্লিখিত আছে।এই হিন্দু রাজ্যের অধিবাসীদের চাম হিন্দু (Cham Hindu)বলা হত। রাজ্যটি ভিয়েতনামের পূর্ব উপকূলের কেন্দ্র থেকে দক্ষিণে বিস্তৃত ছিল এবং বিভিন্ন অংশে বিভক্ত ছিল যার মধ্যে কোয়াং নাম (Quảng Nam) কে চামদের পবিত্র ভুমি হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল। অন্যান্য ভাগ গুলির মধ্যে উত্তরে অমরাবতী (Amaravati / Part of Quang Nam)আর দক্ষিণে পান্ডুরাঙা (Panduranga / Phan Rang), কৌথারা (Kauthara / Nha Trang), বিজয়া (Vijaya / Binh Dinh)ইন্দ্রপুরা (Indrapura) অবস্থিত ছিল। চাম অধিবাসীগণ প্রাচীন ভারতের সাথে শক্তিশালী বানিজ্য সংযোগের কারণে হিন্দু ধর্ম দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিল যা তাদের ধর্মীয় অনুশীলন ও শিল্পকর্ম থেকে স্পষ্টতই প্রমাণিত হয়েছিল। চামেরা বেশীরভাগ কৃষিজীবী, মাছ ধরা, মন্দির নির্মাণ ও ভাস্কর্য শিল্পে দক্ষ ছিল। তাদের কারিগরী দক্ষতার প্রমাণ এখোনো ভিয়েতনাম (Vietnam) ও কাম্বোডিয়ার (Cambodia) প্রাচীন মন্দিরগুলিতে দেখা যায়।

Present Vietnam provinces with their old name (Champa Kingdom)

সেই যুগে চম্পা নগর ছিল বিশ্ব বানিজ্যের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু এবং গুরুত্বপূর্ণ সমূদ্র বন্দরগুলির সাথে এর সংযোগ ছিল। চাম হিন্দুরা জাপান, তাইওয়ান, চীন, ভারত, ফিলিপিন্স, ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়া পর্যন্ত বানিজ্য যোগাযোগ স্থাপন করেছিল। বহু পুরোনো ভাঙা জাহাজের অংশবিশেষ ফিলিপিন্স ও চম্পার মধ্যে সমৃদ্ধ বানিজ্যের প্রমান হিসাবে পাওয়া গিয়েছিল। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন যে চামরা সা হুন (Sa Huynh) এর বংশধর ছিলেন। তারা মালয় দ্বীপপুন্জ থেকে ভিয়েতনামের পূর্ব উপকূলে সমূদ্র পথে প্রায় 1000 খ্রীষ্টপূর্বে যাত্রা করে মূলত চীন ও মালয়ের মধ্যে বানিজ্য স্থাপনের উদ্দেশ্যে। চামেরা ভিয়েতনামে পৌছানোর সময় থেকে সেই দ্বিতীয় শতাব্দী পর্যন্ত একই পূর্ব উপকূলীয় অন্চলে রয়ে গিয়েছিল, অবশেষে চাম কিংডম নামে তাদের রাজনৈতিক সত্তা প্রতিষ্ঠা করেছিল যা প্রায় ১৩০০ বছর ধরে রাজত্ব করেছিল (১৫০-১৪৫০ খ্রীঃ) । 

লোকমতে চাম সাম্রাজ্যের স্থপতি ছিলেন কিউ লিয়েন (Kiu Lien) যিনি তার রাজধানী হু (Hue) এর নিকটে স্থাপনা করেছিলেন, যদিও এর প্রত্যক্ষ প্রমান নেই। ঐতিহাসিক ভাবে লিপিবদ্ধ প্রথম চাম রাজা ছিলেন শ্রী মারা (2nd CE) যিনি প্রথম চাইনিজ দের থেকে মুক্ত হয়েছিলেন। 

২২০ খ্রীষ্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে চীনে হান পতনের পর চম্পা রাজত্বের পরিধি বাড়তে থাকে, ২৪৮ খ্রীষ্টাব্দে চম্পা রাজার বিশাল নৌবাহিনীর কাছে চীন পরাজিত হয়। এলাকা দখলের লড়াই অবশ্য পরবর্তী ১০ বছর যাবৎ চলতে থাকে এবং শেষে চীনের আধিপত্য চিরতরে বিলীন হয়। 

চাম সাম্রাজ্যের সব থেকে প্রভাবশালী রাজা ছিলেন ভদ্র বর্মন এবং ঠিক এই সময়ে চাম সাম্রাজ্যে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রবেশ ঘটে ও চামেরা হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করে। ৬০০ খ্রীষ্টাব্দে মাই সনে (My Son জায়গা ) ভগবান শিবের উদ্দেশ্যে রাজা ভদ্র বর্মন সুন্দর ও আকর্ষণীয় মন্দির নির্মাণ করেন। চামেদের জাতীয় ধর্মীয় মনুমেন্ট হিসাবে ঘোষণা করা হয় এই মন্দির আর মূর্তিকে ভদ্রেশ্বরসভামিন নাম দেওয়া হয়। 

ভারতীয় রাজাদের মত চাম রাজারাও বর্মন উপাধি নিয়েছিলেন তাদের নামের শেষে। ভদ্রবর্মনের পুত্র গঙ্গারাজা তার শেষজীবনে রাজত্ব ত্যাগ করে ভারতে এসেছিলেন এবং এখানেই জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন। গঙ্গা রাজার পর চাম কিংডম পান্ডুরাঙ্গা (Panduranga) , ভ্রিগু (Vhrigu) এরকম ছোটো ছোটো ভাগে বিভক্ত হয়েছিল। অষ্টম শতকের পরবর্তী সময় থেকে রাজধানী মাই সন এর জৌলুশ ধীরে ধীরে কমতে থাকে। 

পান্ডুরাঙ্গা কিংডম ৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ৮৬০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেছিল। অনেক মন্দির তারা পুনরায় নির্মান করেছিলেন যেগুলো জাভা অধিবাসীদের দ্বারা ধ্বংস হয়েছিল। চীন এবং কাম্বুজার (Cambodia Khmer Hindu) বিরুদ্ধে তারা কঠোর পলিসি নিয়েছিলেন। ভ্রিগু রাজাদের (৮৬০-৯৮৫ খ্রীষ্টাব্দ) দ্বারা চম্পা কিংডম পুনরায় শক্তিশালী হয়েছিল বিশেষত ভদ্রবর্মন-৩ এর শাসনকালে (৯০৫-৯১০ খ্রীষ্টাব্দ)। অনেক মূল্যবান তথ্য পাওয়া গিয়েছিল তাঁর বিভিন্ন যুদ্ধজয়ের ব্যাপারে, বিদেশী দূতদেরও আনাগোনা ছিল তার রাজত্বকালে। 

Cham Tower – Vijaya / Binh Dinh

ভদ্রবর্মন-৩ এর পুত্র ইন্দ্রবর্মন-৩ একজন বিখ্যাত স্কলার ছিলেন তার সময়কালে। তিনি সংস্কৃতে পন্ডিত ছিলেন এবং বুদ্ধের দর্শন সম্পর্কেও অবহিত ছিলেন। কাম্বুজা শাসকের আক্রমনে তার রাজধানীর চরম ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। তার পুত্র পরমেশ্বর বর্মনের রাজত্বকালে আন্নামিস (Annamese, North Vietnam or Dai Viet) আক্রমন করেছিল এবং যুদ্ধে পরাজয় ও মৃত্যু হয়েছিল। 

আন্নামিসরা চম্পা কিংডমের একটা বড় অংশ ৯৮৯ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেছিল, পরবর্তীতে চাম নেতা বিজয় শ্রী হরিবর্মন-২ তাদের কে পরাজিত করে নিজের দখলে নিয়ে নিয়েছিল। আন্নামিস রা এই চম্পা কিংডম এয়োদশ শতাব্দীতে (1300 CE) পুনরায় দখল করে এবং  ষোড়শ শতাব্দীতে (১৬০০ খ্রীঃ) মোঙ্গলদের কাছে পরাজিত হলে তা মোঙ্গলদের হাতে চলে যায়। 

Po Klong Garai /Cham temple tower located in Panduranga / Phan Rang, Copyright: Alamy Stock Photo

সপ্তদশ শতাব্দীতে (১৭০০ খ্রীঃ) চম্পা ও দাই ভিয়েত একত্রিত হয় যদিও অলিখিত ভাবে চাম অন্চল আলাদা সত্তা নিয়ে থাকে ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত। ভিয়েতনামে এখোনো খুব কম সংখ্যক চাম অধিবাসী বাস করে। বেশীরভাগ চাম অধিবাসী সপ্তদশ শতাব্দীতে ভিয়েতনামীদের অত্যাচারে মালয়, পেনিনসুলা, জাভা, হাইনান, কাম্বোডিয়া ও সুমাত্রা তে পালিয়ে গিয়েছিল। 

বিংশ শতাব্দীতে (20th Century) চাম জনসংখ্যা ব্যপক হারে কমে যায় যখন ১৯৭৫ – ১৯৭৯ সালে খেমের রুজ (Communist Rule of Khmer Rouge Group, Pol Pot) কমিউনিস্টরা নির্বিচারে হত্যা করা শুরু করে চামেদের। খেমের রুজ কমিউনিস্ট চেয়েছিল খেমের ছাড়া আর কোনো এথনিক মানুষ কাম্বোডিয়ায় থাকবে না। 

আজকের দিনে চামেরা খুব ভালো অবস্থায় আছে ভিয়েতনামে। যদিও ভিয়েতনামী সংস্কৃতির সাথে পুরোপুরি মিশে যাওয়ার জন্য তারা বিভিন্নভাবে চাপ অনুভব করছে।

চামদের ভাস্কর্য্য শিল্প

চামেরা যে হিন্দু মন্দির নির্মান করেছিল তা মূলত পাকা ইটের তৈরী এবং শিখর বিশিষ্ট। অন্যদিকে খেমের হিন্দুরা (কাম্বোডিয়া) যে হিন্দু মন্দির নির্মাণ করেছিল তা মূলত পাথরের। বিভিন্ন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ এখোনো ভিয়েতনাম ও কাম্বোডিয়ার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তার মধ্যে ষষ্ঠ শতকে নির্মিত মাই সন এর শিব মন্দির হল দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সব থেকে পুরোনো মন্দির যা এখোনো পুরোপুরি ধ্বংস হয়নি। ভারতীয় সংস্কৃতি ও হিন্দু ধর্মের ছোঁয়া স্পষ্টভাবে বিদ্যমান এই মন্দির চত্বরে। 

ভিয়েতনামের প্রথম নিজস্ব মুদ্রা

ভিয়েতনাম হল এমন একটি দেশ যার সাথে প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের বা ভারতীয় সংস্কৃতির নিবিড় সংযোগ আছে। ভিয়েতনামের চম্পা নামে এখনো একটি নগর আছে যেখানে ভারতীয় সংস্কৃতির স্থাপত্য দেখতে পাওয়া যায়। বর্মন রাজবংশের রাজার অধীনে একসময় এই চম্পা নগর অন্তর্ভুক্ত ছিল।

আজ দ্রুত অর্থনৈতিক প্রগতির জন্য দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার যে দেশটির নাম বার বার সংবাদের শীর্ষকে দেখা যায়, সেই ভিয়েতনামের অধিবাসীদের দীর্ঘ সংগ্রামের মাধ্যমে আত্মনির্ভরতা অর্জনের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে সাধারণাব্দের দশম শতকের শেষার্ধে নির্মিত প্রথম নিজস্ব মুদ্রা।

ভিয়েতনামের এই প্রথম নিজস্ব মুদ্রা নির্মিত হয় দিন রাজবংশের (৯৬৮-৯৮১ সাল) শাসনকালে, ৯৭০ সাধারণাব্দে। এর পূর্বে ভিয়েতনামে চিনের মুদ্রা প্রচলিত ছিল। আন্নাম অর্থাৎ বর্তমান ভিয়েতনাম ৯৩৮ সাধারণাব্দে চিনের দক্ষিণ হান রাজবংশের আধিপত্য থেকে মুক্তি লাভের পর ৯৪৪ থেকে ৯৬৮ সাধারণাব্দ পর্যন্ত ১২ জন বিবদমান শাসকদের দ্বারা শাসিত হত। দিন বো লিন (রাজত্বকাল ৯৬৮-৯৭৯ সাধারণাব্দ) এই অরাজকতার অবসান ঘটিয়ে প্রথম সমগ্র বর্তমান ভিয়েতনামকে একটি সাম্রাজ্যের অধীনে আনতে সক্ষম হন। তিনি তাঁর সাম্রাজ্যের নতুন নাম দেন ‘দাই কো ভিয়েত’ (মহান ভিয়েত), এই নামই বর্তমান ভিয়েতনাম নামের উৎস। ৯৭৯ সাধারণাব্দে তাঁকে হত্যা করা হয়। স্বল্পস্থায়ী ‘দিন’ রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট দিন বো লিন ভিয়েতনামের ইতিহাসে দিন তিয়েন হোয়াং (প্রথম দিন সম্রাট) নামেও পরিচিত। ভিয়েতনামের প্রথম নিজস্ব মুদ্রা তিনিই নির্মাণ করান।

ভিয়েতনামের প্রথম মূদ্রা

ভিয়েতনামের এই প্রথম নিজস্ব মুদ্রা ছিল ব্রোঞ্জের তৈরি। এই মুদ্রাগুলি ২৫ মিমি ব্যাসের, ২.২ গ্রাম ওজনের, গোলাকৃতি, কেন্দ্রস্থলে চতুষ্কোণ ছিদ্রবিশিষ্ট। মুদ্রাগুলির একপিঠে লেখা থাকত ‘থাই বিন হুং বাও’ (থাই বিন কালপর্ব, অর্থাৎ ৯৭০-৯৭৯ সাধারণাব্দে নির্মিত মুদ্রা) ও অন্যপিঠে লেখা রাজবংশের নাম ‘দিন’। এই মুদ্রা খুব কম সংখ্যায় নির্মাণ করা হয়েছিল।

প্রথম স্বাধীন সত্ত্বার প্রতীক হিসাবে ভিয়েতনামের ঐতিহ্যে এই মুদ্রার একটি উল্লেখনীয় স্থান রয়েছে।

Courtesy : B. Jayanta

References: R.C. Majumder (ed.), The Age of Imperial Unity. Bombay, 1968.


1 thought on “ভিয়েতনামের প্রাচীন হিন্দু চাম বর্মন রাজাদের ইতিহাস।”

Leave a Reply to Abir Cancel Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *