কুচবিহার রাজপ্রাসাদ / মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ ভুপবাহাদুর।

লেখক: কুমার মৃদুল নারায়ণ

ঐতিহ্যময় কুচবিহারের রাজপ্রসাদ আমাদের সকলের কাছে একটি অতি পরিচিত স্থাপত্য। মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ ভুপবাহাদুরের স্পর্শধন্য কুচবিহার রাজপ্রাসাদ  অতীতের গৌরবময় মহিমা নিয়ে আজও সমুজ্জ্বল। প্রখ্যাত কথা-সাহিত্যিক প্রবোধকুমার সান্যাল, তার ‘দেবাত্মা হিমালয়’ গ্রন্থে ভারতের পাঁচটি বৃহৎ রাজপ্রাসাদের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে লিখেছেন—-“কুচবিহারের রাজবাড়ি…..এরা চোখে স্বস্তি আনে”। বরোদার মহারাজের লেখা ‘The Palaces of India গ্রন্থের একটি অধ্যায় জুড়ে রয়েছে কোচবিহার রাজবাড়ির রঙিন আলোকচিত্রের বর্ণনা। প্রকৃতপক্ষে এই রাজপ্রসাদ শুধু কুচবিহার তথা পশ্চিমবঙ্গ নয়, সমগ্র ভারতের মধ্যেই স্থাপত্যকলার অন্যতম নিদর্শন রূপে পরিচিত হবার দাবী রাখে। আজ হয়তো এই রাজপ্রসাদে রাজা নেই, তবে ইতিহাসের বহু ঘটনার সাক্ষী রাজপ্রাসাদ এখনো রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে মহারাজগণ  রাজধানী স্থানান্তরিত করেছেন, মহারাজ নৃপেন্দ্র নারায়ণের পূর্ববর্তী রাজাদের সেইসব পুরনো রাজধানীর ধ্বংসাবশেষ বর্তমানে পাওয়া যায় না বললেই চলে। এর প্রধান কারণ হলো তখনকার রাজধানীর গৃহগুলি প্রধানত মাটি, বাঁশ, খড় দ্বারা তৈরি করা হতো। পরবর্তীকালে অত্যাধিক বৃষ্টিপাত, বন্যা, ভূমিকম্প, প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে সেগুলি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। ১৮৭৪ সাল পর্যন্ত রাজধানী শহরের বেশিরভাগ বাড়ি ছিল মাটির তৈরি। মহারাজা হরেন্দ্র নারায়ণের রাজত্বকালে কুচবিহারের রাজধানীর পরিবর্তন হয়েছিল তিনবার। তৎকালীন সময়ে মাটি, খড়, বাঁশের কাঠামোয় রাজপ্রাসাদ নির্মাণ হয় এবং পরবর্তীতে ভেতরের চারদিকে এবং দেওয়ালের কিছু অংশ ইট দিয়ে গাঁথা হলেও মাটির মেঝের  কোন পরিবর্তন হয়নি। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত আধুনিক কুচবিহারের রুপকার মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ কুচবিহারে আধুনিক রাজপ্রাসাদের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন এবং এরপর থেকেই বর্তমান রাজপ্রাসাদ নির্মাণের পরিকল্পনা শুরু হয়। মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ এবং সুনীতি দেবীর যৌথ উদ্যোগে পাশ্চাত্য স্থাপত্য অনুকরণে এই রাজপ্রাসাদের নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৮৮৩ সালের জানুয়ারি মাসে। ইট তৈরি করার দায়িত্বে ছিলেন মি. ডি. লেনুগারডি। রাজপ্রাসাদের উত্তর  অংশের কাজ প্রথম শুরু হয়। পুরনো বাড়ি ভেঙে নতুন বাড়ি করা হয়। এই অংশের নির্মাণকার্য দ্রুত শেষ করার পর মহারাজা সেখানে থাকতে শুরু করেন। দরবার হল নির্মাণের কাজ শুরু হয় ১৮৮৬ সালের মার্চ মাসে। ইংরেজ ক্লাসিকাল ভাবনা, ইতালীয় শিল্প নৈপুণ্য এবং ভারতীয় কারু ভাবনায় গড়ে ওঠে এই রাজপ্রাসাদ। এই রাজপ্রাসাদ নির্মাণের পর নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা হয়। রাজধানীর স্থানও স্থায়ী হয়।

মহারাজার উৎসাহ এবং পরামর্শে প্রাসাদ নির্মাণের সময় পূর্ব পরিকল্পনার যেমন অনেক পরিবর্তন হয় তেমনি অনেক সংযোজন  হয়। এভাবেই ১৮৮৭ সালে প্রাসাদ নির্মাণের কাজ শেষ হয়। রাজপ্রাসাদটির নির্মাণকার্য সম্পন্ন করার জন্য সেসময় মোট ব্যয় হয়েছিল ৮,৭৭,২০৩ টাকা।

এই প্রাসাদ নির্মাণের কাজকর্ম দেখার জন্য বিখ্যাত স্থাপত্য শিল্পী Mr. F. Barckley কে নিযুক্ত করা হয়। তিনি সেসময় বর্ধমান পৌরসভায় কর্মরত ছিলেন। মেসার্স মলিরিয়ার এন্ড এডওয়ার্ডস কোম্পানি রাজপ্রাসাদ নির্মাণের দায়িত্ব পায়। Mr. Barckley র বিবরণ থেকে জানা যায়, কুচবিহার রাজপ্রসাদ আধুনিক এবং রুচিসম্মতভাবে নির্মিত-এটি ত্রিতল না করে দ্বিতলের উপর গম্বুজ স্থাপন  করা হয়েছে। অট্টালিকা সংলগ্ন দুটি প্রাঙ্গণসহ এই প্রাসাদের মোট আয়তন ৫১৩০৯ বর্গফুট। এর মধ্যে উঠোন যুক্ত হয়ে আছে, যার মোট আয়তন ৭৬৫৯ বর্গফুট। উত্তর-দক্ষিণে এর দৈর্ঘ্য ৩৯৩ ফুট ৭ইঞ্চি এবং পূর্ব পশ্চিমে এর দৈর্ঘ্য ২৯৬ফুট ২ইঞ্চি। একতলাতে অবস্থিত দরবার কক্ষ। দরবার কক্ষটির দৈর্ঘ্য ৭২ফুট, প্রস্থ ৬৫ফুট ৫ইঞ্চি। ভূমি থেকে প্রাসাদের উচ্চতা ১২৪ফুট ১০ইঞ্চি। উত্তর ও পশ্চিম দিকে মূল প্রবেশদ্বার দুটি অবস্থিত এবং একাধিক পার্শ্ব  সিঁড়ি রয়েছে। একতলায় একটি তোষাখানা সহ ২৪টি কক্ষ রয়েছে প্রাসাদের অভ্যন্তরে। রয়েছে ৫টি স্নানাগার। দ্বিতলে ১৫টি শয়ন কক্ষ, ৩টি বৈঠকখানা, ১টি বিলিয়ার্ড কক্ষ, ৪টি তোষাখানা ও ১১টি স্নানাগার রয়েছে। প্রাসাদের পাচকোণে ৫টি সিড়ি। রাজ কর্মচারী এবং দাস-দাসীদের জন্য নির্দিষ্ট আছে আলাদা দুটি লোহার ঘোরানো সিঁড়ি। অন্যান্য সিঁড়িগুলো অষ্টভুজ আকারে তৈরি। তবে দ্বিতলটি সাধারণত রাজ পরিবারের লোকজনের জন্যই নির্দিষ্ট ছিল। দরবার কক্ষের মাঝখানে সুরুচিসম্পন্ন ধাতুনির্মিত অর্ধগোলাকার গম্বুজ। গম্বুজটির জন্য স্টিলের প্লেটগুলি ইংল্যান্ড থেকে আনা হয়।

রাজপ্রাসাদ সংলগ্ন রয়েছে দুটি বৃহৎ গৃহপ্রাঙ্গণ। একটি দৈর্ঘ্য ৭৫ ফুট ৮ ইঞ্চি ও প্রস্থ ৭৬ ফুট ৯ ইঞ্চি। এটি শুধুমাত্র মহিলাদের জন্য ব্যবহৃত হতো। অন্যটির দৈর্ঘ্য হল ৪৮ ফুট, ৯ ইঞ্চি, প্রস্থ ৩৮ ফুট। বহিরাগত অতিথিদের জন্য এটি ব্যবহার করা হতো। এছাড়া প্রাসাদাভ্যন্তরে  একটি সংগ্রহশালা আছে। ইতালিও স্থাপত্য, কলা এবং অলংকরণের এক অপূর্ব সমন্বয় এই প্রসাদ এর প্রধান আকর্ষণ।

রাজ আমলে বহু গণ্যমান্য অতিথি  এসে এই রাজপ্রাসাদে  অবস্থান করেছেন। আবার স্বাধীন ভারতের একটি জেলায় পরিণত হবার পর ‌১৯৫৪  সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বিধান চন্দ্র রায় কুচবিহার এসে এই প্রাসাদে অবস্থান করেন। 

ইতিহাসের বহু ঘটনার সাক্ষী এই ঐতিহ্যময় রাজপ্রাসাদ আজ তার কৌলিন্য হারিয়ে ফেলেছে। আজ রাজপ্রাসাদের ওই জৌলুস আর নেই। শতবর্ষের ঐতিহ্য কুচবিহারের রাজপ্রাসাদ আজ অভিভাবকের অভাবে খাঁ খাঁ করছে। ১৯৮২ সালের  ২০ মার্চ ভারত সরকারের পুরাতত্ত্ব বিভাগ (A.S.I) অধিগ্রহণ করার পর রাজপ্রাসাদটি  জাতীয় সৌধ হিসেবে ঘোষিত হয়েছে।

প্রথম পর্বে প্রাসাদের চারটি কক্ষ সংস্কার করে ১৩/৭/১৯৯৮ তারিখে মিউজিয়ামের উদ্বোধন করা হয়। মূল গেট থেকে প্রাসাদ পর্যন্ত রাস্তার দুপাশে আলো এবং সাউন্ড বসানো হয় এবং প্রাসাদের সামনে আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু বর্তমানে এই ঐতিহ্যময় রাজপ্রাসাদটি সব কিছু থেকে বঞ্চিত হয়ে আছে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায়। তবুও আমরা ঘটনাবহুল অতীত ইতিহাসের কথা নিয়ে গর্ববোধ করি। আর কবির ভাষায় বলি- “নব জীবনের সংকট পথে হে তুমি অগ্রগামী, তোমার যাত্রা সীমা মানিবে না, কোথাও যাবে না থামি।”

বি.দ্র :- 1) আগামীকাল মহারাজার জন্মদিন উপলক্ষে একটি সুন্দর কবিতা লিখেছেন আমার সহকর্মী তথা বিশিষ্ট কবি, ভেটাগুড়ি নিবাসী অভিজিৎ দাশ মহাশয় । কবিতাটি নীচে দেওয়া হল–

মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ন

অভিজিৎ দাস 
 
রাজা তো প্রজাপালকই হওয়া উচিত 
ইতিহাসে তা বিরল হলেও
একেবারে শূন্য নয়।
চন্ডাশোকও একদিন 
যুদ্ধ-বিগ্রহ ছেড়ে হয়েছিলেন 
প্রজাহিতৈষী ধর্মাশোক।
হর্ষবর্ধন তার পরনের কাপড়টিও বিলিয়ে দিতেন।
 
কোচবিহারের শিক্ষা-সংস্কৃতির ও উন্নয়নের পথে পেয়েছিল এমনই এক রাজা,
যার হাত ধরে হাঁটি হাঁটি পা পা —–
উঠে দাঁড়িয়েছিল 
আধুনিক কোচবিহার।
রূপকথার জাদুকাঠি স্পর্শে
 স্বমহিমায় ঝলমল করছিল।
 আর জাদুকরটি এর চেয়ে দেখছিল
 তোর্সার বুক থেকে উঠে আসছে
ভোরের স্নিগ্ধ সূর্য।


2) মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ ভুপবাহাদুর এবং রাজ প্রাসাদের চিত্র অঙ্কনের সুন্দর প্রচেষ্টা করেছে জলপাইগুড়ি নিবাসী আমার অত্যন্ত স্নেহের ভাই প্রসূন রায় ডাকুয়া। আমি তার প্রচেষ্টাকে কুর্নিশ জানাই। 

তথ্যসূত্র :- কুচবিহারের ইতিহাস সম্পর্কিত বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে সংগ্রহীত।


# Maharaja Nripendra Narayan, Coochbehar Palace, Maharaja of Baroda, Mr. D. Lenugardi,

1 thought on “কুচবিহার রাজপ্রাসাদ / মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ ভুপবাহাদুর।”

Leave a Reply to David Anderson Cancel Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *