পঞ্চানন বর্ম্মা সহযােগী হেদেল্লা বর্ম্মা এবং মাথাভাঙ্গা পরগনার নায়েব আহিলকার আশুতোষ ঘােষ

পঞ্চানন বর্ম্মা সহযােগী হেদেল্লা বর্ম্মা এবং মাথাভাঙ্গা পরগনার নায়েব আহিলকার আশুতোষ ঘােষ

অজিত কুমার বর্মা

তৎকালীন কুচবিহার রাজ্যের মাথাভাঙ্গা পরগনার প্রশাসনিক আইনি পর্যায়ের একটি অলিখিত অধ্যায়। অলিখিত বললাম এই কারণেই যে শুধুমাত্র এই বিষয়টি নিয়ে এ পর্যন্ত কোথাও লেখা হয়নি। এমনকি চিন্তন সমাজেও কোথাও আলােচনা-পর্যালােচনা হয়নি। যতটুকু তথ্য ও তত্ত্ব পাওয়া যাচ্ছে তা মাথাভাঙ্গার বা এই পরগনার অন্য পর্যায়ের ইতিহাসে প্রসঙ্গক্রমে আসা। এবং তাও খুবই সামান্য। তা দিয়ে প্রমাণ আকারের একটি প্রবন্ধ লেখা খুবই কঠিন। তবুও এই পরগনার সুচিন্তিত পাঠক সমাজের দৃষ্টি আকর্ষন করতেই এই প্রসঙ্গের অবতারণা। প্রসঙ্গের কেন্দ্রবিন্দুতে আছেন হেদেল্লা বর্ম্মা নামের একজন ক্ষত্রিয় রাজবংশী কর্মকর্তা এবং তৎকালীন নায়েব আহিলকার আশুতােষ ঘােষ ও প্রতক্ষ্য বা অপ্রতক্ষ্যভাবে পঞ্চানন বর্ম্মা।

একজন উত্তরপূর্ব ভারতের মনীষী, রাজবংশী জাতির জনক পঞ্চানন বর্মা। অন্যজন চাকরি করতে আসা বাঙালি প্রশাসক কর্ম্মচারী এবং তৎকালীন কুচবিহার রাজ্যের সাধারণ রাজবংশী প্রজা হেদেল্লা বর্ম্মা।

পরিচিতি

পঞ্চানন বর্ম্মা:

তৎকালীন মাথাভাঙ্গা ME স্কুলের কুচবিহারের কৃতি সন্তান। উত্তরপূর্ব ভারতের প্রথম স্নাতকোত্তর ডিগ্রীধারী প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব। আইন পাশ করে ওকালতি পেশায় নিজেকে নিয়ােজিত করেন রংপুরে। এবং এই রংপুরে অবস্থানকালে সমাজ সেবায়, সমাজ সংস্কারের কাজে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে নিবেদিত করেন। তিনি একাধারে সমাজ সংস্কারক, কামতাবেহারী ভাষা সাহিত্যের উপাসক, নারী কল্যাণকামী, নারী নির্যাতনকারী নিপাতী, সমগ্র রাজবংশী জাতিকে শিক্ষায়-দীক্ষায় উচ্চ শিখরের আলােয় আলােকিত করার প্রচেষ্টায় নিয়ােজিত, নিবেদিত একজন যােগী।

আশুতােষ ঘােষ:

যিনি জীবিকার টানে স্বতন্ত্র কুচবিহার রাজ্যের একটি পরগনার নায়েব আহিলকার হয়ে আসা রাজকর্ম্মচারী। উনবিংশ শতাব্দীর ৭০এর দশকে জন্ম গ্রহণ করেন আশুতােষ ঘােষ। ছাত্রাবস্থাতেই পিতৃদেব বিয়ে দিয়ে দেন আশুতােষ ঘােষের সঙ্গে নারায়ণী দেবীর। বিয়ের পর তিনি আইন পরীক্ষা পাশ করে দেশীয় রাজ্য কুচবিহারে আসেন নায়েব আহিলকারের চাকরি নিয়ে। আশুতােষ ঘােষের তেরটি সন্তান। মাথাভাঙ্গা পরগনার এলিট সংস্কৃতি মনস্ক মানুষজনের সঙ্গে তাঁর ছিল নিবিড় যােগাযােগ। তিনি নারী শিক্ষা প্রসারেও অগ্রণী ভুমিকা পালন করেছিলেন। তিনি মদনমােহন বাড়ির পার্শস্থ জমি প্রদান করে নাট্যমঞ্চ তৈরির ব্যবস্থা করে দেন। মাথাভাঙ্গার বুকে যে হলটি আজও আশুতােষ হল নামে সুপরিচিত। “অবসররঞ্জিনী” নামক একটি দলও তারই উৎসাহে মাথাভাঙ্গার বুকে সৃজন হয়। যে দলের মধ্যমণিও ছিলেন তিনি। (কিন্তু তিনি পাশাপাশি এই ‘অবসররঞ্জিনী’-তে বেছে বেছে এমন মানুষজনকে গ্রহণ করতেন যে তা সাধারণ মাথাভাঙ্গাবাসী ভাল চোখে দেখতেন না। এ ঘটনার প্রত্যুত্তরেই কি মাথাভাঙ্গার বুকে অন্য একটি দলের নাম পাওয়া যায় যে নামটি শুনলেই প্রতিবাদী ভাবনা মনে আসে। সে দলের নাম ‘অবহেলিত গােষ্ঠী’। তবে কি অবহেলার পাত্র যারা তাঁরাই এ দলের প্রতিষ্ঠাতা? নাকি আশুতােষ বাবুর সেই এলিট ভাবধারাকে ধাক্কা দেওয়ার জন্যই পরবর্তীতে তৈরি হয়েছিল ‘অবহেলিত গােষ্ঠী’?)

নায়েব আহিলকার আশুতােষ ঘােষ সম্বন্ধে যতটুকু জানা যায় তা তাঁর সুযোগ্যা কন্যা ও মাথাভাঙ্গার অন্যতমা প্রেয়সী নারী রাধাময়ী দেবীর কথাতে এবং তাঁর সুযােগ্য সন্তান, পুত্র বিভূতিভূষণ-এর লেখনীতে। এবং মাথাভাঙ্গা সারস্বত উৎসবের মুখপত্র মানসাই-এর লেখক, প্রবন্ধকার অনিন্দ ভট্টাচায্যের প্রবন্ধ ‘উনিশ শতকীয় মনন ও মাথাভাঙ্গার এলিট সংস্কৃতি ও ব্রাহ্মভাবধারার উত্তরাধিকার’-এ। সারস্বত উৎসবের মুখপত্র মানসাই পত্রিকার প্রবন্ধকার তন্ময় রায় ও রাজর্ষি বিশ্বাসের প্রবন্ধ, ‘সােনামণি দেবীর সংক্ষিপ্ত তজীবনকথা’ তে পাওয়া যাচ্ছে আশুতােষ ঘােষ ১৯০৭ সালে মাথাভাঙ্গা গার্লস স্কুলের সম্পাদক নিযুক্ত হন। আশুতােষ ঘােষ ছিলেন ব্রাহ্মভাবধারার মানুষ। তিনি মাথাভাঙ্গা পরগনার নায়েব আহিলকার পদে অধিষ্ঠিত থাকা কালে কৃতি ছাত্র-ছাত্রীদের বৃত্তি প্রদান করতেন নিজের অর্থেই। ১৯০৭ সালে মাথাভাঙ্গার বুকে কৃতি ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বৃত্তি প্রদান মাথাভাঙ্গার ইতিহাসে গৌরবের অধ্যায়।

হেদেল্লা বর্ম্মা:

যে তিনজনের আলােচনা এ আলােচনায় তাদের মধ্যে সবথেকে অবদমিত যে মানুষটি তিনি হলেন হেদেল্লা বর্ম্মা। পঞ্চানন বর্ম্মার ভাবাদর্শে দীক্ষিত মাথাভাঙ্গার হাজরাহাট নিবাসী কৃষক এবং মাথাভাঙ্গার ক্ষত্রিয় সমাজের প্রধানতম ব্যক্তি। তিনি অন্য দুজনের থেকে ধারে-ভারে, শিক্ষায়-দীক্ষায় যােজন দূরত্বে দাঁড়িয়ে। কিন্তু এই আলােচনার কেন্দ্রে তিনিই অবস্থিত। তাঁর পিছনে দাঁড়িয়ে তৎতকালীন কুচবিহার রাজ্যের একজন মহানতম ব্যক্তিত্ব এবং আইন পেশায় নিযুক্ত ব্যক্তি পঞ্চানন বর্ম্মা। এবং অপরদিকে তাঁর প্রতিপক্ষ কুচবিহার রাজ্যের নায়েব আহিলকার অ-দেশীয় মানুষ আশুতােষ ঘােষ।

আশুতােষ ঘােষের অপশাসন এবং ক্ষত্রিয় সমাজের উপর অন্যায় অত্যাচার:

ক্ষত্রিয় সমিতির বৃত্ত বিবরণীতে পাওয়া যাচ্ছে হেদেল্লা বর্ম্মা একজন প্রধানতম ব্যক্তি মাথাভাঙ্গা ক্ষত্রিয় সমাজের সামাজিকগণের মধ্যে। মাথাভাঙ্গা পরগনার তৎকালীন ক্ষত্রিয় কর্মকাণ্ডের প্রধান মুখ। তিনি ক্ষত্রিয় সমিতির বিভিন্ন কর্মকাণ্ড সুচারুরূপে পালন করতেন। তিনি এবং তৎকালীন ক্ষত্রিয় সমিতির প্রচারক শ্রীযুক্ত ক্ষীরনারায়ণ বর্ম্মা একটি শালিসী সভায় উপস্থিত ছিলেন। সেই শালিসী সভায় একজন দুষ্কার্য্যকারী ব্যক্তির বিচার হয়। ঐ ব্যক্তিটি গ্রামে কোন একটি দুষ্কার্য্য করে। একবার শাসন করিলে কিছুদিন দুষ্কার্য্য করা ছাড়িয়া দেয়। কিছুদিন নিশ্চুপ থাকিয়া আবার তিনি সেই দুষ্কার্য্যটি করিতেন। বারংবার ঐ লােকটি দুষ্কার্য্য করা়য় শালিসী সভায় তাঁকে অধিকতর অর্থ দণ্ড করা হয়। সেই শালিসী সভার ১৫/১৬ দিন পর দুষ্কার্য্যকারী মানুষটি আত্মহত্যা করে। পুলিস যথারীতি তদন্ত করিয়া রিপাের্ট করিল যে ঘটনাটি আত্মহত্যা। এবং ফৌজদারী কার্য্য বিধির ১০৯ বা ১১০ ধারার কোন প্রমান নাই।

অথচ নায়েব আহিলকার আশুতােষ ঘােষ ফৌজদারী কার্য্য বিধির ১০৯ ও ১১০ ধারা অনুসারে অর্থাৎ চোরাই মাল রাখা, চোরের থাপাইত হওয়া এবং অসদুপায়ে জীবীকা অর্জন করার দায়ে দায়ী করিয়া শ্রীযুক্ত হেদেল্লা বর্ম্মা ও শ্রীযুক্ত ক্ষীরনারায়ণ বর্ম্মা মহাশয়ের নামে নােটিশ জারি করাইলেন। মােকদ্দমা চলিতে লাগিল। অন্যায় ও অনিষ্টকর ভাবিয়া ক্ষত্রিয় সমাজ দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হইয়া মােকদ্দমা চালাইতে লাগিলেন। মাথাভাঙ্গাবাসী ক্ষত্রিয়গণ সবাই অর্থ সাহায্য করিলেন। দীর্ঘদিন মােকদ্দমাটি চলার পর মােকদ্দমাটি ডিস্মিস্ হইয়া গেল। এই মােকদ্দমায় শ্রীযুক্ত হেদেল্লা বর্ম্মা অযাচিত বহু অর্থ ও বহু কষ্ট স্বীকার করিয়াছেন। তবুও তিনি সমাজের গৌরব রক্ষার জন্য সর্বদা অটল ও উদ্দমী ছিলেন। সেজন্য তাঁহাকে ক্ষত্রিয় সমিতিথেকে কৃতজ্ঞতা ও সাধুবাদও জানানাে হয়।

Continue Reading..