প্রবন্ধ উত্তরবঙ্গের রাজবংশী সমাজে বাল্যবিবাহ - পরিতােষ কার্যী

VSarkar

রাজবংশী সমাজে বাল্যবিবাহ

উত্তরবঙ্গের রাজবংশী সমাজে বাল্যবিবাহ / Rajbanshi child marriage, North Bengal

paritosh karjee
Paritosh Karjee

সামাজিক বহু কুপ্রথার মতাে বাল্যবিবাহ একটি অতি ঘৃণ্য কুপ্রথা। যার প্রভাব সমাজবদ্ধ মানব জীবনে এক গভীর ক্ষয়ের সৃজন ঘটায় উত্তরবঙ্গের রাজবংশী সমাজজীবনে কেমন ছিল এই প্রথার রূপ বা আদৌ ছিল কিনা? তারই তত্ত্ব-তালাশ করার প্রচেষ্টাতে এই প্রবন্ধের অবতারণা।

রাজবংশী সমাজ ছিল মূলতঃ মাতৃতান্ত্রিক সমাজ। যেখানে মায়েদের অর্থাৎ নারীদের প্রাধান্যের কথা স্বীকার করা হয়। অবশ্য বহিঃকর্মের ক্ষেত্রে পুরুষদের প্রাধান্য ঘটে। এই মাতৃতান্ত্রিক রাজবংশী সমাজের বাল্যবিবাহ প্রথা অতিমাত্রায় ছিলাে এটা কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় না। ভাবতে আশ্চর্য লাগে বর্ণহিন্দুরা যেদিন আপন কন্যা সম্তানকে কোলে করে বিয়ের পিড়িতে বসাতাে, বাল্যবিবাহের কুফল জেনে উঠতে পারেনি, কিংবা জানলেও ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির রক্ত চক্ষুকে, তাঁদের অন্যায় নিয়মকে উপেক্ষা করতে পারেনি; সেই সময়কালে রাজবংশী সমাজ বিবাহের ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন ছিল। বিবাহে নারীদের প্রাধান্য ঘটে থাকে, তদুপরি রাজবংশী সমাজ ছিল মাতৃতান্ত্রিক, তাই বিয়ের ব্যাপারে মায়ের কথাই শিরােধার্য রূপে গণ্য করা হত। তৎকালে রাজবংশী সমাজে বিবাহ উপযােগী বয়স কন্যার ক্ষেত্রে ছিল ১৬/১৭বছর, বরের ক্ষেত্রে ছিল ২১/২২ বছর। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, রাজোপাখ্যানে লিখিত আছে যে রাজা বিশ্বসিংহের পিতা হরিদাস মণ্ডলের (হরিয়া মণ্ডল) বিবাহ হয় রাজকন্যা হীরার সাথে। কন্যার মা প্রথমে এই বিবাহে রাজি হননি, কারণ হীরা তখন নয় বৎসরের বালিকা। ‘যৌবন প্রাপ্তি না হওয়া পর্যন্ত কন্যা পিতৃগৃহে অবস্থান করিবেন।’ হরিদাসের পিতা এই প্রতিশ্রুতি দেয়ার পরেই কিন্তু হীরার সাথে বিবাহ ঘটা সম্ভব হয়েছিল, তার আগে নয়

এক্ষেত্রে বােঝা যাচ্ছে যে বর্ণ হিন্দুসমাজের প্রভাবের জন্য ইংরেজ সরকার ১৯৩০ সালে সারদা আইন লাগু করে বাল্য বিবাহকে নির্মূল করতে চাইল। স্থির হল বিবাহের ক্ষেত্রে বরের বয়স ২০-৩০ বছর এবং মেয়েদের ক্ষেত্রে ১৪-১৬ বছর হতে হবে। ডঃ চারুচন্দ্র সান্যাল জানিয়েছেন – “In Cooch Behar it was 10-12 for the girl and 20-23 for the boy”. কাগজে লিপিবদ্ধ আইন কাগজে থেকে গেল, তার সুবাস উত্তরবাংলার গণ্ডগ্রামে পৌছাতে পারলাে না। তাই আরাে বহুকাল বাল্য বিবাহ চলতে থাকল রাজবংশী সমাজে। ধীরে ধীরে এই জ্ঞানের আলাে এই বদ্ধসমাজের ফাক ফোকর দিয়ে প্রবেশ করার পর বহু কুসংস্কারের মতাে বাল্য বিবাহ ক্ষয় পেতে শুরু করে। অবশ্য তাতে স্বাধীন ভারত দয়া না করলে হয়তাে তাও হত না। কিন্তু আজো- কি হে রাজবংশী সমাজ বাল্যবিবাহের কালিমা সম্পূর্ণ মুছতে পেরেছে? কেন আজও কঙ্কালসার চতুদর্শী পঞ্চদশীরা সন্তান কোলে করে মৃত্যুর প্রতিক্ষা করে?

অতীতকালে রাজবংশী সমাজে বাল্যবিবাহ প্রথা ছিল না। তাহলে এই সমাজে বাল্যবিবাহ কবে থেকে শুরু হয়? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে গেলে প্রথমে জেনে নিতে হবে বর্ণহিন্দুদের প্রভাব রাজবংশী সমাজে কবে থেকে পড়তে শুরু করে।

কোচ রাজবংশের প্রথম রাজা বিশ্বসিংহের পিতা হরিদাস মণ্ডল হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করেননি। সমগ্র কোচ সমাজ আপন ধর্মচারণে নিয়ােজিত ছিল। তবে তখন সমগ্র কামরূপ রাজ্যে যে ব্রাহ্মণ ছিল না এমনটা নয়। কারণ রাজা নীলধ্বজের রাজত্বের সময়কালেও আমরা ব্রাহ্মণদের দেখা পেয়ে থাকি। হান্টার জানিয়েছেন – “হাজোর দৌহিত্র বিশুর সময়ে কোচ জাতির মধ্যে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম সর্ব প্রথমে প্রবিষ্ট হইয়াছিল এবং বিশু স্বকীয় কর্মচারী ও প্রধান অধিবাসীগণের সহিত হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করিয়া ছিলেন।” ডাক্তার ক্যাম্বেল বিশ্বসিংহের ভ্রাতা শিষ্যসিংহ প্রসঙ্গে জানিয়েছেন – যদিও রাজা (তৎকালীন রায়কত) আপনাকে হিন্দু বলিয়া প্রচার করিতে অভিলাষী, তথাপি তাঁহাকে প্রকৃত ‘হিন্দু বলা যাইতে পারে না।” অর্থাৎ একথা বলা যায় যে, রাজা হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন সপরিষদ এবং প্রধান অধিবাসীদের নিয়ে একথা সত্য। কিন্তু হিন্দু ধর্মের সমস্ত নিয়ম কানুন, কৃষ্টি সংস্কৃতিকে পূর্ণ আয়ত্ত করতে পারেননি। কারণ আপন মজ্জাগত সমাজ সংস্কৃতি এতাে সহজে মানুষকে মুক্তি দেয় না। হয়তাে এই কারণেই রাজা আপনাকে “হিন্দু” বলে পরিচয় দিলেও প্রকৃত হিন্দু হতে পারেননি। আবার খান চৌধুরী আমানতউল্লা আহমেদ ‘কোচবিহারের ইতিহাস’ গ্রন্থে জানিয়েছেন “বিশ্বসিংহের রাজ্য প্রাপ্তির সময় ইইতেই যে ইহাদের (কোচরাজবংশী) মধ্যে হিন্দু ধর্মাবলম্বনের সূত্রপাত হইয়াছে, এইরূপ উক্তির সমর্থক কোন প্রমাণ বিদ্যমান নাই। “আবার তিনি জানিয়েছেন – “সেখ আবুল ফজল ‘আকবর নামায়’ লিখেছিলেন যে বিশ্বসিংহের মাতা জল্পেশ্বর শিবের আরাধনা করিয়া তাঁহাকে পুত্র রপে প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। সুতরাং বিশ্বসিংহের মাতা পিতা যে হিন্দু ছিলেন, তাহা নিশ্চিতভাবে জানিতে পারা যাইতেছে।” খান চৌধুরী আমানতউল্লাহের দেওয়া এই তথ্যকেও যদি আমরা সত্য বলে ধরি তবুও কিন্তু একথা বলা যায় একজন মণ্ডলের এক্তিয়ারে থাকা স্থানে তাঁর গৃহীত ধর্ম প্রজা সাধারণের ধর্মে আমূল পরিবর্তন ঘটাবে এমনটা বলা যায় না বা ঘটেওনি। তবে প্রভাবিত করেছিল বা করাটা সম্ভব এটা ঠিক।

পরবর্তী রাজা বিশ্বসিংহের প্রথাগত পুরােহিত কলিতাদের এবং মৈথিলি ব্রাহ্মণদের তাদের পূজ্য আসন থেকে সরিয়ে দিয়ে শ্রীহট্ট থেকে বৈদিক ব্রাহ্মণদের আনেন। এই অনুগ্রহপুষ্ট ব্রাহ্মণরাই তার দৈব জন্মের কাহিনী প্রচার করেন। বুকানন লিখেছেন- “(বিশ্বসিংহের) দেবতার অংশে জন্ম গ্রহণের এই প্রচারিত কাহিনীকে অনুসরণ করে কোচেরা, অন্ততপক্ষে সেই সব কোচেরা, যারা হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করেছিল এবং তাদের অসংস্কৃত আচরণকে বর্জন করেছিল, তারা রাজবংশী অথবা রাজার বংশধর এই পরিচয় গ্রহণ করে। …..হীরার বংশধরগণ তাদের ঐশ্বরিকজন্মের খ্যাতিতে আরাে গর্বিত হয়ে দেব অথবা প্রভু পদবী গ্রহণ করে এবং রাজপরিবারের রাজদন্ডধারী সদস্যরা ব্যবহার করতে থাকে নারায়ণ পদবী। “সাম্প্রতিক এক আলােচনায় বলা হয়েছে যে, “বিশ্বসিংহ নিজে হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করেন এবং শিব ও পার্বতীর উপাসক হন। ….সমস্ত কোচবিহারে তিনি হিন্দুদের বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন এবং এইসব মন্দিরে পূজার জন্য মিথিলা থেকে বাহ্মণ নিয়ে আসেন।” ষোড়শ শতাব্দীর শুরুতে কামরূপে কলিতা ও ব্রাহ্মণদের পৌরােহিত্যে যে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম তথা আর্যধর্ম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তাতে হিন্দু ধর্ম অপেক্ষা বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাবকেই ইঙ্গিত করে বেশি বলে মনে করেন অনেক পণ্ডিত। আসলে বিশ্বসিংহের আবির্ভাবের পুর্বে এক হাজার বছরের মধ্যে বঙ্গদেশের মতাে কামরূপ রাজ্যেও বৌদ্ধ মতের প্রভাব বিপুল। যে ধর্মীয় ব্যালান্স তিনি তৈরি করেছিলেন তাতে তাঁর ধর্ম প্রসার প্রচেষ্টায় বিরূপ প্রভাব ফেলেছিল। শেষপর্যন্ত রাজপোষকতা সত্ত্বেও ‘ব্রাহ্মণ্য ধর্ম মাঝপথে থেমে গিয়েছিল।’ পরবর্তী রাজগণ মন্দির প্রতিষ্ঠা, দেবােত্তর সম্পত্তি দানছাড়া হিন্দু ধর্ম প্রচারে তেমন কোন রেখাপাত করে যেতে পারেননি।

পরবর্তীকালে উত্তরবঙ্গে ইংরেজ গবেষকদের আগমন রাজবংশীদের সামাজিক, রাজনৈতিক ইত্যাদি দিক থেকে প্রভাবিত করে। ইংরেজ আগমনের সাথে তাদের সৃষ্ট বাঙালি কেরানীকুল ঘাঁটি গাড়তে থাকে বিপুল পরিমাণে (তবে যে শুধু বাঙালি এসেছিল তা নয়)। পারস্পরিক সহাবস্থান পরস্পরকে প্রভাবিত করবে এটাই তো স্বাভাবিক। তবে রাজবংশী সমাজে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রভাব তথা প্রবেশ ঘটে রাজবংশী কুলমুকুট রায় সাহেব পঞ্চানন বর্মার ক্ষত্রিয় আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে। আপাত অচ্ছুত ব্রাত্য ভঙ্গক্ষত্রিয় রাজবংশী সমাজকে গণউপবীত ধারণের মধ্য দিয়ে তিনি ব্রাহ্মণ্য ধর্মের তরীতে ভিরিয়ে দিলেন। সেই সূত্রধরেই ব্রাহ্মণ্য ধর্মের গুণগুলাের সাথে সাথে দোষগুলােও প্রবেশ করে রাজবংশী সমাজে। বাল্যবিবাহ ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি থেকেই পাওয়া।

Continue Reading..

এবারে ব্রাহ্মণ্য ধর্মে বাল্যবিবাহের অবস্থা সংক্ষেপে দেখে নিই। আমরা সকলেই জানি ব্রাহ্মণ্য ধর্মে দেবমাহাত্ম্য প্রচার মূলক যেসমস্ত কাব্য নাটক রয়েছে তাতে বিবাহকালীন কন্যার বয়স অষ্টম-নবম হামেশাই পেয়ে থাকি। অর্থাৎ বাল্য বিবাহ যে ব্রাহ্মণ্য ধর্মে অতি প্রাচীন তারই ইঙ্গিত দিচ্ছে, পরবর্তীকালে বল্লাল সেন কৌলিন্য প্রথা সৃজন করে বাল্যবিবাহকে ব্যাপকতর এবং করুণতর করে তােলে। কুলীনঘরে কন্যার বিবাহ দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগে কুলীন পিতারা। মেয়ের বয়স বেড়ে গেলে সমাজ চ্যুতির ভয় এবং কুলীন বর না পাওয়ার ভয়ে মৃত্যু পথযাত্রী বৃদ্ধ কুলীন বরের সাথে কিশােরী কন্যার বিবাহ দিত। ফল হত অতি করুণ। ইংরেজদের আগমনে পাশ্চাত্যের জ্ঞান বৈভব আমদানী হতে থাকে আমাদের দেশে। বঙ্গ দেশে কলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালী হিন্দু সমাজ সচেতন ও শিক্ষিত হলেও কিন্তু হিন্দু সমাজের এই সমস্ত কুপ্রথা দূর হয়নি। উনবিংশ শতক যাকে আমরা বাঙালীর নবজাগরণের কাল বলি তখনাে কিন্তু বাল্য বিবাহ রমরমিয়ে চলছিল। তদানীন্তন বাল্যবিবাহের এক করুণ চিত্র লীনা চাকী তাঁর ‘বাউলের চরণ দাসী’ গ্রন্থে লিখেছেন – ১৮৬৪ সালের কার্তিক মাসের বিদ্যাদর্শন পত্রিকার পঞ্চম সংখ্যায় কোলকাতার মেছােবাজার অঞ্চলের এক যৌনকর্মীর চিঠি ছাপা হয়েছিল। তিনি (বেশ্যা) লিখেছেন – ‘আমি শান্তিপুর নিবাসী এক কুলীন ব্রাহ্মণের কন্যা ছিলাম’। আমার শৈশবকাল বাল্যক্রীড়ায় যাপন হইয়া যৌবনে প্রারম্ভ হইলাে; তথাপি আমার পিতা মাতা বিবাহের উদ্যোগ করেন না ইহাতে আমি প্রতিবাসিনী কোন রমনীর নিকট এই প্রস্তাব উত্থাপন করিয়া অবগত হইয়াছিলাম যে তিন বৎসর অপেক্ষা অল্প বয়ঃক্রমকালীন আমার বিবাহ হইয়াছে”। এবারে আমাদের প্রণম্য পরিচিতি জ্ঞানী পণ্ডিত মানুষদের বিবাহের বয়স এবং তাদের পাত্রীর বয়স তুলে ধরছি-

পাত্রের নাম পাত্রের
বিবাহকালীন বয়স
পাত্রীর
বিবাহকালীন বয়স
১. দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১২
২. ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৪
৩. কেশবচন্দ্র সেন ১৮
৪. শিবনাথ শাস্ত্রী ১২ ১০
৫. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ২২ ১১

(‘আজকাল পত্রিকা’ ৩রা সেপ্টেম্বর ২০০৮)

বাল্যবিবাহ রােধে ১৮৬০ সালের আইনের একবিশেষ ধারায় বলা হয়েছিল ১০ বছরের কম বয়সী মেয়েদের কৌমার্য হরণ আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। আবার পরবর্তীকালে ১৮৭২ সালের Act III অনুসারে বিবাহের ক্ষেত্রে বরের বয়স ১৮ কনের বয়স ১৪ বছর নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। কিন্তু আইন প্রণয়ন করলেই যে একটা কুপ্রথা হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যাবে এমনটা ভাবা ভুল। তার জন্য চাই সামাজিক সচেতনতা এবং আন্দোলন। তাই আরাে কয়েক দশক পেরিয়ে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের আন্দোলনে ইংরেজের সদিচ্ছায় বাল্যবিবাহ রােধের চেষ্টা করা হয়। ১৯৩০ সালে ‘সারদা আইন’ মােতাবেক বিবাহকালীন বর -কনের বয়স যথাক্রমে ১৪-১৬, ২০-৩০ নির্ধারিত হয়। পাশাপাশি স্ত্রী শিক্ষার বিস্তার, সচেতনতা বাল্যবিবাহকে ছুঁরে ফেলতে সাহায্য করে। কিন্তু সম্পূর্ণ নির্মূল হয়েছে একথা আজও বলার সাহস কারাে বুকে নেই।

পূর্বেই উল্লেখ করেছি রাজবংশী সমাজে বাল্যবিবাহের প্রবেশ ঘটে হিন্দু করণের হাত ধরে। হরমােহন খাজাঞ্চি যে আন্দোলনের সূত্রপাত করেন তারই সূত্র ধরে রাজবংশী সমাজে প্রথম এম.এ.বি, এল ঠাকুর পঞ্চানন আপনজীবন অভিজ্ঞতায় জেনে যান বর্ণহিন্দুরা কেমন চোখে দেখে তাকে, তাঁর সমাজকে। শুরু হয় আন্দোলন। ১৯১০ খ্রীষ্টাব্দে ১লা মে প্রতিষ্ঠা করেন ‘ক্ষত্রিয় সমিতি’ । অনেক লড়াই, আন্দোলন, তর্কবিতর্কের পর তিনি প্রতিষ্ঠিত করেন রাজবংশী সমাজ উপবীত গ্রহণে অধিকারী। ১৯১৩ সনে (১৩১৯ বঙ্গাব্দের ২৭ শে মাঘ) করতােয়া নদীর ধারে ঘটেছিল রাজবংশী সমাজের ব্রাত্যত্ব মােচন এবং মস্তক মুণ্ডন করে উপবীত ধারণ। কিন্তু ঠাকুর পঞ্চানন জানতেন শুধু উপবীত গ্রহণ করলেই যে একজন মানুষ ক্ষত্রিয় হতে পাবে তা কিন্তু নয়, তাই তিনি আপন সমাজকে ক্ষাত্রতেজ গুণ সংস্কার আয়ত্ত করার দিকে জোর দিলেন। এরই পথ ধরে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের ভালাে সংস্কার গুলাের সাথে খারাপ সংস্কারও রাজবংশী ক্ষত্রিয় সমাজে প্রবেশ করল, তারই একটা রূপ হল বাল্যবিবাহ। ক্ষত্রিয় আন্দোলনের পর থেকেই যে রাজবংশী জনসমাজে বাল্যবিবাহের প্রবেশ ঘটে একথার সমর্থনে চারুচন্দ্র সান্যালকে দাঁড় করিয়ে দেওয়া যায়। তিনি রাজবংশীদের সম্পর্কে জানিয়েছেন – “About half a century ago the marriageable age of the girl was 16 and 17 and of the boy 21 and 22. After about twenty five years the age of the girl was reduced to 9 and 10” (The Rajbansis of North Bengal ). এই গ্রন্থখানি চারুচন্দ্র সান্যাল রচনা করেছেন ১৯৬৫ খ্রীষ্টাব্দে। সেই সময়ে তিনি জানাচ্ছেন পঞ্চাশ বছর আগে নাগাদ বিবাহ যােগ্য বর, কনে বয়স যথাক্রমে ২১-২২, ১৬-১৭ বাঞ্ছনীয় ছিল। অর্থাৎ বর কনের বিবাহের বাঞ্ছনীয় বয়সের এই কাঠামাে ১৯১০, (ক্ষত্রিয় সমিতি প্রতিষ্ঠা) কিংবা ১৯১৩ (উপবীত গ্রহণ) সালের পরেরকার নয়, পূর্বের আবার রাজবংশী সমাজের উদ্ভবের প্রাক্কালেও যে বাল্যবিবাহ ছিল না পূর্বে লিখিত হরিদাস মণ্ডলের বিবাহের ব্যাপারটা জানলেই প্রমাণ করা যায়।

যাই হােক বাল্যবিবাহ তার মাকাল ফলগুলােকে সাথে নিয়ে রাজবংশী সমাজে প্রবেশ করে। সেই ফল ধীরে ধীরে বীজ, বীজ থেকে একপাতা দুপাতা করে শাখায় প্রশাখায় পল্লবিত হয়ে করাল ছায়া ফেলে। বাল্যবিবাহকে আরাে তরান্বিত করেছিল রাজবংশী সমাজে প্রচলিত কন্যাপণ এখন যেমন বর পণ প্রথা প্রচলিত, তৎকালে কন্যার পিতামাতাকে কন্যা পণ দিয়ে মেয়েকে বিবাহ করতে হত। বিবাহের যােগাযােগকারী ‘করেয়া’ অর্থাৎ ঘটকের কাছে হবু বর কনের তালিকা থাকত। ঘটকের তদ্বিরে মেয়ে পছন্দ হওয়ার পরেই কন্যাপণের কথা উঠত। হাটে বাজারে যেমন জিনিস পত্রের দর উঠত তেমন করে মেয়েদেরও দরদাম হত। মন-পছন্দ হলে কন্যার পিতামাতা বিবাহে সম্মতি দিত। এই কারণে রাজবংশী সমাজের বিবাহকে কন্যার পিতা বলত ‘বেচে খাওয়া’। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যেত গরীব পিতামাতা টাকার লােভ সামলাতে না পেরে অতি অল্প বয়সে কন্যার বিবাহ দিত, দ্বিতীয়ত বেশি পয়সার লােভে অর্থবান অথচ বয়স্ক লােকেদের সাথে বালিকা-কন্যার বিবাহ হত অনেক সময় দেখা যেত স্ত্রী মারা গেলে কিংবা স্ত্রী থাকা সত্বেও পুরুষেরা অর্থের জোরে বালিকা বধু ঘরে আনতে পারত। ফল হত মারাত্মক। হয়তাে দেখা যেত পিতার সমবয়সী বা তারও বেশি বয়সের পুরুষের সাথে বালিকা কন্যার বিবাহ হচ্ছে। বেশি বয়স কালে পুরুষের বিবাহ যে দ্বিতীয় বা তৃতীয় বিবাহ কালীন সময়েই ঘটত এমনটা নয়। অনেক সময় দেখা যেত কন্যাপণ যােগার করতে করতেই অনেক বছর কেটে গেছে, বয়স বেড়ে গেছে। সুতরাং বয়সের পার্থক্য ঘটতে থাকত। বয়স্ক স্বামীর পঞ্চত্ব প্রাপ্তি ঘটলে শুরু হত অকাল বৈধব্যে অসহ্য যন্ত্রণা, ফলত ঘটত সামাজিক দূষণ।

চারুচন্দ্র সান্যাল জানিয়েছেন, পন্চাশ বছর আগে কন্যাপণ ছিল ৫০-১০০ টাকা। কোচবিহারে ১৯১১ সাল নাগাদ ছিল ৪০-৫০ টাকা। তাঁর সময়কালে ছিল ৫০-১০০ টাকা কন্যাপণ একজন গরীব পরিবারের ক্ষেত্রে। তৎকালে দার্জিলিং এবং নেপালে সংখ্যাটা ছিল যথাক্রমে ৩০০-৫০০ টাকা। বাল্যবিবাহের উদাহরণ চারুচন্দ্র সান্যালের গ্রন্থ থেকেই তুলে ধরছি —‘১৯৫০ সালে জলপাইগুড়ির কামার পাড়া নিবাসী ফনীন্দ্র নাথ দাস ১৪ বছর বয়সে বিবাহ করেন, কনের বয়স ১২ বছর। বৈশাখু রায় জলপাইগুড়ি সন্ন্যাসী পাড়ার বাসিন্দা, ১৮ বছর বয়সে বিবাহ করেন ১৪ বছর বয়সী পইত্তা দাসীকে, কন্যাপণ ছিল ৮০ টাকা। সেই বৈশাখু রায় দ্বিতীয় বিবাহ করেন ২৮ বছর বয়সে , হবু স্ত্রী ফুলমতির বয়স ছিল ১০ বছর, কন্যাপণ ছিল ১৪০ টাকা।

বাঙালি হিন্দু সমাজ যখন পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হতে শুরু করল, জ্ঞানের চোখে সবকিছুকে পরখ করে নেওয়ার চেতনা পেতে শুরু করে, আপন সমাজের বদ্ধতা, অন্ধ কুসংস্কারগুলাে ঝেড়ে ফেলে এগিয়ে চলতে শুরু করল, তখন রাজবংশী সমাজে জ্ঞানের আলাে অত্যন্ত ম্রীয়মান, বলতে গেলে নেই। রায় সাহেব পঞ্চানন বর্মা এই পিছিয়ে পড়া জাতিকে টেনে তােলার বহু প্রচেষ্টা করেন, ব্যবস্থা করেন শিক্ষাদীক্ষার। সংরক্ষণের জন্যই আন্দোলন গড়ে তােলেন। কিন্তু তবুও যতটা পিপাসা ততটা জলের বন্দোবস্ত ঘটাতে তিনি পারেন নি। তাই ব্রাহ্মণ্য শিক্ষিত সমাজ বাল্যবিবাহ ত্যাগ করতে শুরু করলেও রাজবংশী সমাজ তার আঁচ পর্যন্ত পায়নি। কিন্তু সময়ের পরিবর্তন ও যুগবদলের সাথে সাথে রাজবংশী সমাজেও এই বাল্যবিবাহ প্রথার অবসান ঘটছে। হয়তাে বা থাকবেও না।

তথ্যসূত্র:
১. ‘আজকাল পত্রিকা’ ৩ সেপ্টেম্বর ২০০৮।
২. উত্তরবঙ্গের ইতিহাস ও সমাজ জীবন – সম্পাদক, ড. আনন্দগােপাল ঘােষ ও ড. নীলাংশু শেখর দাস।
৩. উত্তরবঙ্গ ও অসমের রাজবংশী সম্প্রদায় এবং ভূমি ব্যবস্থার পরিবর্তনশীল কাঠামাে, শিনকিচি তানিগুচি, অনুবাদক – শিবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়।
৪. রাজবংশী সমাজের বিবাহ – হিতেন নাগ।
৫. The Rajbansis of North Bengal – Charu Ch. Sanyal.
৬. বাউলের চরণ দাসী – লীনা চাকী।

কৃতজ্ঞতা স্বীকার:
১. ড. দিলীপ কুমার দে, ২. ড. দীপক কুমার রায়।


অস্তিত্বের সংকট/ কোচ রাজবংশী সমাজে বিবাহের কিছু সীমাবদ্ধতা এবং নিষেধাজ্ঞা

কোচ রাজবংশী সমাজের বৈশিষ্ট্য, অভ্যাস ও রীতিনীতি / সাথে কিছু মন্তব্য

# Paritosh Karjee # Child Marriage in Rajbanshi Society of North Bengal # KochRajbanshi # Thakur Panchanan Barma # Hiten Nag