গামছার রঙ বিতর্ক প্রসঙ্গে, বিরুদ্ধ মতের ব্যক্তিদের শ্রদ্ধা জানিয়ে..

গামছার রং বিতর্ক প্রসঙ্গে, বিরুদ্ধ মতের ব্যক্তিদের শ্রদ্ধা জানিয়ে, আমার আজকের বিষয়—রাজবংশীদের সংস্কৃতি ও Ethnicity--একটি গবেষণাধর্মী লেখা।

📝লেখক: রতন বর্মা


রাজবংশীদের জানতে গেলে,বুঝতে গেলে প্রথমেই রাজবংশীদের ethnicity নিয়ে অধ্যয়ন করা উচিত। আদিকাল থেকেই রাজবংশী সমাজ প্রকৃতি পূজায় বিশ্বাসী। তাই আদিকাল থেকে রাজবংশীদের সংস্কৃতি চর্চায় প্রাকৃতিক বা প্রকৃতি থেকে জাত উপাদানের প্রাচূর্য্য লক্ষ্য করা যায়। রাজবংশীদের বাড়িতে শিবপূজা বলতে একখন্ড পাথর বা শিলা। প্রত্যেক বাড়িতে সেই পাথররূপী শিবলিঙ্গ পূজিত হয়ে আসছে সেই আদিকাল থেকে। বিষহরি বলতে বাঁশের তৈরি ‘ঠকা’ আর মাটি দিয়ে তৈরি ঢিপি। পরবর্তীতে মনসা রূপে মাটির তৈরি মূর্তির আকার নিয়েছে !! রাজবংশীদের যাত্রাপূজার উপকরণ বাড়িতে ব্যবহৃত সব ব্যবহার সামগ্রী। “যাত্রাশিস”(একধরণের গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ)-এর ব্যবহার হয় এক্ষেত্রে। পৌষমাসে পৌষসংক্রান্তিতে মানুষের আগে গৃহপালিত পশুদের আগে পিঠা খাওয়ানো হয়। এই পিঠা বিশেষভাবে তৈরি। কোনরকম তেলের ব্যবহার হয় না এতে। বেষমা/বিষুয়া/শিরুয়া চৈত্রসংক্রান্তিতে পালনীয় একটি পরব। এই পরবে নানান রকমের গুল্মজাতীয় বৃক্ষের ব্যবহার। আর এই সমস্ত গুল্ম শুধুমাত্র রাজবংশী অধ্যুষিত অঞ্চলেই পাওয়া যায় বেশি। প্রচলন রয়েছে নানান ধরনের শাক-পাতায় তৈরি এক বিশেষ রকমের খাবার। বিভিন্ন শষ্যদানা দিয়ে তৈরি হয় ‘ফুটাফাটি’। তেতো জাতীয় গুল্ম দিয়ে তৈরি হয় হয় এক বিশেষ ধরণের মিশ্রন যা শরীরের পক্ষে খুবই উপকারি। কিছুদিন আগে হয়ে যাওয়া “কাতিগছা পার্বণ”, লক্ষীরূপ ধানগাছের পূজা, গচিবুনা সবেতেই রয়েছে প্রকৃতির সাথে অবাধ সম্পর্ক।  সব পার্বণের কথা লিখতে গেলে অনেকটা সময় লেগে যাবে।


দেশীয় প্রযুক্তিতে উৎপন্ন শুকনা মাছ দিয়ে তৈরি শিদল আর ‘আটিয়া কলার’ গুড়ির শুকনা অংশ দিয়ে তৈরি সোডার মিশ্রনে তৈরি ছ্যাকা এক অতি সুস্বাদু খাবার। এতে রয়েছে ক্যালসিয়াম আর ক্ষারের উপাদান যা আমাদের শরীরে দরকারি। 


ভাবছেন এত কথা কেন বলছি ????

বলছি একারণেই…
কারণ রাজবংশীরা এই অঞ্চলের আদিপুরুষ। এই অঞ্চলের প্রকৃতি এবং প্রাকৃতিক উপাদানগুলির সাথে এদের তাই এত সমতা, এত বোঝাপড়া,এত যোগাযোগ, এত আন্তরিকতা। এটা অনেকেই বুঝতে চায় না। রাজবংশীরা এতদ্অঞ্চলের ethnic জনগোষ্ঠী। তাই এদের সংস্কৃতির উপর কিছু চাপিয়ে দেওয়া চলে না। রাজবংশীদের সংস্কৃতি অন্যসব প্রভাবে কিছুটা সংস্কৃত হয়েছে ঠিকই। কিন্তু originality এখনও থেকেই গেছে।
রাজবংশীদের পোষাকে ফোতা/পাটানী এবং গামছার প্রভাব আদিকাল থেকেই লক্ষ্য করা যায়। মূলত কৃষিকাজ করতে গেলে গামছা পরেই সুবিধা হয়। 
আর গামছার রং নিয়ে যারা বিতর্ক করে রাজবংশীদের মধ্যে বিভেদ সৃস্টির প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন তাদের এই চেষ্টা অশুভ।  কোন সামাজিক সংগঠনের নিজস্ব রং থাকতেই পারে। কিন্তু সেটা সমগ্র জাতির উপর চাপিয়ে দেওয়া ঠিক নয় বলে আমি মনে করি। হলুদ রংয়ের ব্যবহার রাজবংশীদের শুভ কাজের সাথে সম্পর্কযুক্ত। বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে প্রায় সবধরণের অনুষ্ঠানে কাঁচা হলুদ চাকা চাকা করে কেটে ব্যবহার হয়। রক্ত শুদ্ধ করতেও কাঁচা হলুদের উপকারিতা মারাত্মক। বিয়ের আগের দিন বরের গায়ে হলুদ মাখানো হয়। আর গামছা দিয়ে সেই  শরীর মুছলে তাতে হলুদ লাগবে এটাই স্বাভাবিক। সেই হলুদ রং তাহলে কিন্তু শুভ বার্তাই বহন করে।


শোনা কথা: 

বিশ্বমহাবীর চিলা রায় যুদ্ধে যাওয়ার আগে একটি বিশেষ পূজা করতেন। সেই পূজায় একটি সাদা পায়রাকে(কবুতর) কাঁচা হলুদের রং দিয়ে মাখিয়ে ছেড়ে দিতেন। আর সেই পায়রা যে অভিমুখে যেত চিলা রায়ও সেইদিকে যুদ্ধযাত্রা করতেন। আর প্রত্যাশামত সাফল্যও আসত। আর তখন থেকেই কাঁচা হলুদযুক্ত গামছার প্রচলন শুরু।
** যদিও নিন্মোক্ত অভিমতের কোন প্রমাণ আমার হাতে নেই।
পৃথিবীর যেকোন সংঠগন তার নিজস্ব ধারায় চলতেই পারে। তাতে কারো আপত্তি থাকার কথা নয়। তাই বলে অন্যের মান্যতাকে আমরা অগ্রাহ্য করতে পারি না বা করা উচিত নয়। যে গামছা দেশের প্রধানমন্ত্রী,মুখ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে গবেষক,অধ্যাপক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ ব্যবহার করছেন এবং মেনে নিয়েছেন সে বিষয়ে বিতর্কের অবতারণা করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে বলে আমি মনে করি না।

ধন্যবাদান্তে, রতন বর্মা।

2 thoughts on “গামছার রঙ বিতর্ক প্রসঙ্গে, বিরুদ্ধ মতের ব্যক্তিদের শ্রদ্ধা জানিয়ে..”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *