ষাটের দশকের রাজবংশী মানুষের জীবনযাপনের কিছুটা অংশ

কোচ রাজবংশী মানুষের জীবন যাপনের কিছুটা অংশ বিশেষ করে পুরুষ আর নারীর যাপন প্রণালীর কিছুটা যা ডঃ চারুচন্দ্র সান্যাল মহাশয় তাঁর “দি রাজবংশীস অফ নর্থবেঙ্গল, 1965 ” বইতে লিখেছেন তা তুলে ধরলাম। কিছু মন্তব্যও থাকল শেষে। 

যাপন প্রণালী –

পুরুষ

একজন রাজবংশী কৃষক খুব সাদাসিধে জীবনযাপন করেন। নতুন সভ্যতার ধাক্কায় অর্থবান এবং শিক্ষিত পরিবারগুলির জীবনযাপন জটিল হয়ে পড়ছে। একজন সাধারণ রাজবংশী কৃষক তাঁর নেংটি নিয়েই খুশি। নেংটিতে 1.5 ফুট একখন্ড মোটা কাপড়, কোমড় থেকে সামনের দিকে ঝোলে – পিছনের দিক থাকে সম্পূর্ণ খোলা। শরীর সবসময় খোলা থাকে, মাথাও কোনো আভরণ থাকে না, পা খালি। বর্ষায় আর শীতে তাঁরা পায়ে খরম পরেন, একটা পাতলা সুতি বস্ত্র (গিলাপ) গায়ে জড়ান। অনেক বছর আগে মোটা সিল্ক বা এন্ডির সিল্ক থেকে গিলাপ তৈরী হত। ঘরেই পশুপালন, চাষ করে আর চরকায় সুতো কেটে তৈরি হত এই কাপড়। আসাম সীমান্তে আলিপুরদুয়ারের কুমারগ্রাম অন্চলে এই পুরোনো প্রথার চল এখনো দেখা যায় এঁরা বাজার থেকে কেনা ছাতা ব্যবহার করেন। দরিদ্র শ্রেণীর মানুষ “মাথাল” (টুপির নাকান ঝাপি) ব্যবহার করেন। মাথায় ঠিকঠাক বসাবার জন্য ইউরোপীয়দের সোলার টুপির মত এর মাঝখানের অংশটি উঁচু আর ভেতরটা ফাঁপা। এক বছরের জন্য এটা জল আটকাবার কাজ করে। এটা দিয়ে শুধু মাথা ঢাকা যায়, শরীর নয়।তিস্তা নদীর পশ্চিমদিকে অর্থাৎ রাজগন্জ এবং শিলিগুড়ি এলাকায় এই মাথালগুলো লম্বা হয়। মাথা আর পুরো পিছনের দিকটা ঢেকে রাখা এই আবরণকে বলে ঝাপি। বাজার বা শহর যাবার সময় রাজবংশীরা পুরো ঢাকা কাপড় পড়েন, গায়ে দেন যে কোনও রঙের জামা বা রং মিলানো জামা। শহরে যাবার সময় বা উৎসব অনুষ্ঠানে ব্যবহার করার জন্য একজোড়া জুতো যত্ন করে তোলা থাকে। অনভ্যস্ত পায়ে নতুন জুতো পরে ফোসকা নিয়ে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে শহরে হাঁটছেন – এই দৃশ্য বিরল নয়। যাঁরা জুতো পরায় সচ্ছন্দ তাঁদের হাঁটতে কোনও অসুবিধা হয় না।   

রাজবংশী পুরুষ বছরের সব ঋতুতেই প্রত্যকেদিন স্নান করেন। নেংটি পরেই তারা স্নান করেন। স্নানের পর গায়ের জল মুছে তিনি অন্য কাপড় পরেন – কাপড় ছাড়ার সময় তিনি কখনো উলঙ্গ হন না। মাথায় সরষের তেল মাখেন কিন্ত অর্থনৈতিক অবস্থার জন্য রোজ তেল মাখতে পারেন না। বাজারে বা শহরে যাবার সময় তিনি মাথায় তেল মাখেন – আর তেল মাখেন স্নানের পরে, কখনো স্নানের আগে নয়। সাধারন কৃষকের বাড়িতে সাবান ব্যবহারের চল নেই। গায়ের ময়লা পরিস্কারের জন্য খৈল, সাজিমাটি আবার কখনো কলাগাছের খোল পুড়িয়ে তার ছাই (খার বা ছেকা) – ও ব্যবহার করা হয়। স্নানের পর কাপড়ের জল নিংড়ে বেড়াতে মেলে দেওয়া হয় শুকাবার জন্য। প্রত্যেকদিন কাপড় ছাড়ার অভ্যাস থাকে তাঁদের। যদি গুরুতরভাবে অসুস্থ না হন তবে রাজবংশী পুরুষ কখনো একদিনের বেশি অকাচা কাপড় পরেন না। 

নারী

রাজবংশী নারী তাঁর “ফোতা” (1) নিয়েই খুব সন্তুষ্ট। “ফোতা” হচ্ছে 5 হাত লম্বা আর 2.5 হাত চওড়া রঙিন বস্ত্রখন্ড যা বাঁধা থাকে বুকের উপর আর ঝুল থাকে হাঁটুর নীচে। ফোতার দুই প্রান্তে সেলাই থাকে না – এটা একটা খোলা বস্ত্রখন্ড। গত দশ বছর হল বাজারে “ফোতা” পাওয়া যায় না। উপযুক্ত দরে সুতো না পেয়ে, মিলের কাপড়ের সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে, গ্রামের তাঁতিরা ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছেন। সুতরাং নানা রঙের বৈচিত্র্যময় মনোরম ফোতার স্থান দখল করেছে মিলে তৈরী যেকোনো ধরনের শাড়ি।   

শাড়ির নিচে সায়া বা গায়ে ব্লাউজ পরার কোনও রেওয়াজ নেই। বাহু, হাত, বুকের উপরের অংশ ঢাকা থাকে না; পা, পায়ের পাতাও খোলা থাকে। রাজবংশী রমণী কখনো জুতো পরেন না। পরদাপ্রথা নেই সুতরাং মাথায় ঘোমটাও থাকে না। সাদাসিধে রাজবংশী রমণী সাধারনত খুবই স্বাস্থ্যবতী ও কমনীয় হন। তাঁর পদক্ষেপ সাবধানি, লোকজনের সামনে যাতে হাস্যাস্পদ প্রমাণিত না হন, সে ব্যাপারে তিনি সচেতন। আচার আচরণে খুব পরিস্কার, পরিচ্ছন্ন। প্রত্যেকদিন পরিবারের জন্য রান্না করার আগে এবং শৌচাগার থেকে ফিরে অপরিচ্ছন্ন (ছুয়া কাপড়) নিজেকে পরিস্কার রাখার জন্যও গা ধোওয়া অভ্যাস। স্নান করার সময় কাপড় খোলেন না স্নানের পর গামছা দিয়ে হালকাভাবে গা মোছেন বা অধিকাংশ সময়ে পরনের ভেজা ফোতা বা শাড়ি নিংড়ে তা দিয়েই গা মোছেন। শরীরে একটা শুকনো শাড়ি বা ফোতা জড়িয়ে ভিজে বস্ত্রটিকে এমনভাবে খুলে ফেলেন যে মোটেও খোলা শরীর দেখা যায় না। তারপর তিনি ভিজে কাপড় কেচে, জল নিংড়ে বাড়ির বেড়ায় মেলে দেন শুকোবার জন্য। সম্ভবত দামের জন্য সাবান ব্যবহার করা হয় না বদলে খৈল, সাজিমাটি, খার অথবা ছেকা দিয়েই গা পরিস্কার করা হয়। টাকার অভাবেই চুলে প্রতিদিন সরষের তেল জোটে না। তেল মাখার অভ্যেসও স্নানের পরে, আগে নয়। শুধু যখন সে বাড়ির বাইরে কোনও আত্মীয় বা বন্ধু (সাগাই)-র বাড়ি কিংবা বাজারে বা শহরে যায় মাথায় জবজবে করে সরষের তেল মাখে। তেল কখনো গাল চুঁইয়ে পড়ে।   

বর্তমানে অনেক শিক্ষিত এবং স্বচ্ছল ঘরের রাজবংশী মেয়েরা শহরের মানুষের সংস্পর্শে এসে দক্ষিণবঙ্গের প্রথায় শাড়ি পরছেন। কেউ কেউ ব্লাউজ, সায়া পরছেন আর গন্ধ তেলও মাখছেন। এই মহিলাদের একটা বিরাট অংশ ঘোমটা দিচ্ছেন – লোকজনের সামনে বেরোচ্ছেন না।”   

সূত্র: (1) মার্টিন, ইস্টার্ন ইন্ডিয়া (1838),পৃঃ 489, হুকার, হিমালয়ান জার্নাল (1584), পৃঃ 273, হান্টার, পৃঃ 270

গ্রামের একটি প্রচলিত কথা – হাজার টাকার কুচুনি তাঁও বান্ধে বুকুনি অর্থাৎ কোচ রমণী যদি ধনীও হন বুকের উপর ফোতা বা বুকুনি বাঁধেন।”


কিছু কথা:

 লেখক কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিশেষ কোন ব্যক্তির জীবন প্রণালী বা আর্থিক অবস্থা খারাপ হওয়ার জন্য যেভাবে জীবনযাপন করেছেন তা পুরো কোচ রাজবংশী সমাজের উপর চাপানোর চেষ্টা করেছেন। এখানে একজন গ্রামীন গরীব রাজবংশী মানুষের জীবন যাপনকেই বেশি করে ব্যক্ত করা হয়েছে। সচ্ছল ও শহরের রাজবংশী কে ব্যতিক্রম হিসাবে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।    যদি গ্রামের গরীব মানুষের জীবনকে ধরা হয় পুরো সমাজ হিসাবে তাহলে শুধু রাজবংশী নয় বাঙালী, বিহারী সব জায়গার গ্রামের মানুষের জীবনযাপন কম বেশী এরকমই। আমি জানি 1965 সালের সমাজকে দেখেছে এমন অনেক কোচ রাজবংশী মানুষ লেখকের অনেক বক্তব্যকে খন্ডাবেন। কারন উনি ওঁনার বইতে বিশেষ কয়েকটা জায়গার কোচ রাজবংশী পরিবার কে নমুনা বা sample হিসাবে নিয়ে পুরো কোচ রাজবংশী সমাজকে দেখানোর চেষ্টা করেছেন যা পুরোপুরি সঠিক নয়।    রাজবংশী পুরুষ নেংটি আর রাজবংশী নারী ফোতা নিয়েই সন্তুষ্ট , এটাও পুরোপুরি ঠিক নয়। পরিবার থেকে পরিবার বা জায়গা ভেদেও এর পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।

গা পরিস্কারের জন্য বিশেষ মাটি আর কাপড় কাচার জন্য খার / ছেকা পুরোপুরি অর্গানিক, যার কোনো পার্শপ্রতিক্রিয়াই নেই। সরষের তেল মাথায় এবং স্নানের পরে মাখানোর নিয়ম ভারতের অনেক জায়াগাতেই গ্রাম্য পরিবেশে দেখা যায়। তবে উপরের লেখকের এই বই যথেষ্ট মূল্যবান তথ্য বহন করেছে।   

আজকের দিনে কোচ রাজবংশীর সংস্কৃতির ক্রমঅবলুপ্তির জন্য দায়ী কোচ রাজবংশী নিজেরাই যা শুরু হয়েছিল অতীতকাল থেকে।

©️VSarkar

Koch Rajbanshi traditional dress, Koch Rajbanshi life style in 1960s. Information collected from book Uttarbanger Rajbanshi by Dr. Charuchandra Sanyal.